তারেক রহমানের দেশে ফেরার সম্ভাবনা: কিছু কথা

টিনিউজ ডেস্ক: দেশ রূপান্তর পত্রিকায় ১১ অক্টোবরের শিরোনাম ‘জানুয়ারিতে ফিরতে পারেন তারেক’। অনেকের মতো আমার মনেও তারেক রহমানের দেশে ফেরা আশার সঞ্চার করে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের উপস্থিতি অতীব জরুরি। এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে আলাপ চলে আসে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার কুক্ষিগত বিচার বিভাগ তারেক রহমানের সঙ্গে যে বৈষম্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে অবিচার করেছে, তার প্রতিকার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।

জাতি, রাষ্ট্র এবং জনগণের সংকটে দৃঢ় ও দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আমরা আজও ভুলে যাইনি ৭ নভেম্বর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমে হতাশায় নিমজ্জিত নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্জাগরণ। তেমনি খালেদা জিয়ার স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আপসহীন সংগ্রামে জাতিকে একতাবদ্ধ করা। আওয়ামী লীগের বহুল প্রচারিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং দেশ বিভাজনের বয়ানের মৃত্যু ঘটেছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে। জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সব আক্রমণ ও অপপ্রচার মোকাবেলা করে টিকে গেছে এবং সময়ের পরিক্রমায় এখন উত্তীর্ণ।পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে রাষ্ট্র সরকার, আওয়ামী লীগ এবং ব্যক্তি হাসিনা মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে পড়েছিল। আমূল সংস্কার ব্যতীত এর থেকে পরিত্রাণের বিকল্প নেই।

আমাদের সবার মনে থাকার কথা, ১৩ জুলাই ২০২৩ তারিখেই তারেক রহমান রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফার রূপরেখা ঘোষণা করেন এবং একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত জতীয় সরকারের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। আমরা সবাই এখন কি তা চাই না? জাতিকে এই মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন এমন নেতা বাংলাদেশে বেশি নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য যে খালেদা জিয়া দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার পরও তিনি হাসপাতাল থেকে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে একতা এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় এই ভাষণের ভূমিকা অপরিসীম।

খালেদা জিয়ার পরে এমন নেতা, যাঁর আহ্বানে জাতি সাড়া দেবে, তেমন একজনই আছেন এবং তিনি তারেক রহমান। শত ষড়যন্ত্র এবং আক্রমণ মোকাবেলা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অক্ষত এবং অটুট থেকেছে সুদূর লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নেতৃত্বে। আমাদের মাঝে তাঁর উপস্থিতি এই নেতৃত্ব আরো দৃঢ় এবং ফলপ্রসূ করবে।বর্তমানে একটি বিতর্ক দেখা দিয়েছে, এমনকি খোদ বিএনপিতেও এ নিয়ে মতভেদ আছে, তা হলো তারেক রহমান কোন প্রক্রিয়ায় দেশে ফিরবেন। তারেক রহমান আমাদের ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনুকম্পায় দেশে ফেরা তাঁর ভাবমূর্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাকি থাকে রাজনৈতিক আন্দোলন অথবা আইনি মোকাবেলার মাধ্যমে তাঁর দেশে ফেরার রাস্তা সুগম করা।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন জনগণ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করার সম্ভাবনা প্রবল। বিগত ১৫ বছরের দুঃশাসন থেকে বের হয়ে বিপর্যস্ত জাতিকে পুনরুদ্ধার এখন জনসাধারণের অগ্রাধিকার। এসব বিবেচনায় তারেক রহমানের আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলা এবং রায় হওয়া মামলাগুলো মোকাবেলা করার মাধ্যমে ফেরাই উত্তম। এই পদ্ধতিতে এরই মধ্যে নির্যাতিত নেতা মাহমুদুর রহমান ও শফিক রেহমান পথ দেখিয়েছেন।

তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চলমান এবং রায় হওয়া মামলাগুলোর নিরপেক্ষ পর্যালোচনা বেশ কিছু গণমাধ্যমে এসেছে। আগ্রহী পাঠকদের বিবিসি বাংলায় ২১ আগস্ট ২০২৪-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন পড়ে দেখার অনুরোধ করছি। তদন্ত এবং বিচার বিভাগকে ন্যক্কারজনকভাবে প্রভাবিত ও দলীয়করণের মাধ্যমে তারেক রহমানকে কিভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে এবং অবশেষে আদালত থেকে রায় বের করা হয়েছে, তা বোঝার জন্য আমরা দুটি মামলার কিছু বিষয়ে আলোকপাত করতে পারি।বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে কলঙ্কিত এবং আতঙ্কজনক ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় প্রথম অভিযোগপত্র এক-এগারোর সরকার ২০০৮ সালে আদালতে পেশ করে এবং বিচারকাজ শুরু করে। যে এক-এগারোর সরকার সত্য-মিথ্যা সব অজুহাতে তারেক রহমানের সম্মানহানিতে সক্রিয় ছিল, তারাও এ মামলায় তারেক রহমানকে জড়ানোর কোনো তথ্য-প্রমাণ আদালতে দাখিল করতে পারেনি। নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিয়মবহির্ভূতভাবে অবসর থেকে ফিরিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পর বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দকে এই মামলায় অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং প্রধান আসামিদের মাঝে অন্যতম মুফতি হান্নানকে ৪০০ দিন রিমান্ডে অকথ্য নির্যাতন শেষে তারেক রহমানকে জড়িয়ে জবানবন্দি আদায়ের মাধ্যমে মামলার পঞ্চম অভিযোগপত্রে তারেক রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর বিচারের নামে যা হয়েছে, তা হলো প্রহসন।

মুফতি হান্নান নিজে আদালতে তারেক রহমানকে জড়িয়ে স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন করলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। এমনকি তারেক রহমানের আইনজীবী মুফতি হান্নানকে জেরা করার সুযোগ পাননি। অন্য কোনো সাক্ষী তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেননি। আর মুফতি হান্নানকে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে তড়িঘড়ি করে ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে তাঁর কাছ থেকে সত্য উষঘাটনের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দের দলীয় আনুগত্য নিয়ে জনমনে এখন আর কোনো দ্বিধা নেই। আর পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অনুগত পুলিশ কর্মকর্তারা কেমন দানব হন তার উদাহরণ বেনজীর, হারুন আর বিপ্লবরা আমাদের সামনে জাজ্বল্যমান।

২০০১ ও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনে নিজ এলাকায় কাজ করা এবং ২০১৮ সালে দলীয় মনোনয়নে ডামি নির্বাচনে অংশ নেওয়া কাহহার আকন্দ এখন যথারীতি পলাতক। বিএনপির আমলে জজ মিয়া নাটকের অভিযোগ আর আওয়ামী লীগের আমলে সঠিক তদন্ত বয়ানকারীরা কিছু সত্য চেপে যান। বিএনপি আমলে কোনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি এবং তাদের সময়ই প্রথম মুফতি হান্নান গ্রেপ্তার হন। বিএনপির সময়কালে মামলাটি তদন্তাধীন ছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্তে বাধা দেওয়া এবং আলামত নষ্ট করার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ আছে। তার চেয়েও ভয়ংকর অভিযোগ আছে স্বয়ং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। শেষ মুহূর্তে সমাবেশের স্থান পরিবর্তনের কারণ এখনো অজানা। চ্যানেল আই ২৩ আগস্ট ২০২৪ তৎকালীন পুলিশের ঢাকার ডিসি খান সাঈদ হাসানের একটি সক্ষাৎকার প্রচার করেছে, আগ্রহী পাঠককে সেটি দেখার অনুরোধ থাকল।

গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে যথার্থই বলেছেন, ‘একটা ঘটনাকে উপলক্ষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কিভাবে কোণঠাসা বা নির্মূল করা যায়, তার একটা চেষ্টা হয়েছিল। এটা ২০০৫-০৬-এ যেমন হয়েছিল, তেমনি ২০০৯-এর পর থেকেও হয়েছে। এটার পুনঃ তদন্ত হবে আমি মনে করি। কারণ এটার পেছনে আরো অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে।’গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর গণমাধ্যমে বিচারক মোতাহার হেসেনের একটি বক্তব্য প্রচার পেয়েছে। তাঁর বক্তব্য থেকে তারেক রহমানকে দোষী করে রায় দেওয়ার জন্য ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার যে ভয়ংকর চাপ প্রয়োগ করেছিল তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এর পরও নিজের বিবেক এবং বিচারক হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালনের ফলে আওয়ামী অত্যাচারে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এই বিচারকের মতে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা সেই মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ অনুযায়ী সাজা দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাজা দিতেই লিখিত রায়ে স্বাক্ষর করার চাপও ছিল মোতাহের হোসেনের ওপর।

বিচারিক আদালতে বেকসুর খালাস লাভের পরও হাইকোর্ট তারেক রহমানকে সাত বছরের করাদণ্ড দেন, অথচ তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ বা তথ্য আদালতে সরকার প্রমাণ করতে পারেনি।তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এক-এগারোর সরকার যে বিস্তর দুর্নীতি এবং চাঁদাবাজির ঢালাও অভিযোগ এনেছিল, তার কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। বরং এখন বের হয়ে আসছে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করে এক-এগারোর সরকার এবং আওয়ামী পৃষ্ঠপোষকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করতে বাধ্য করেছে। আর আছে ‘অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত’ কিছু দলীয় ব্যক্তির করা মামলা। আর সরকারের করা কিছু ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলা। এখনো দেখা যায় অনেক মানুষের মনে তারেক রহমানকে নিয়ে সন্দেহ এবং দ্বিধা। আমার অনুরোধ হলো অমূলক সন্দেহের বশে উপসংহার না টেনে ব্যক্তি তারেক রহমান ও তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত হওয়া এবং তাঁর যোগ্য মর্যাদা দেওয়া। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দানা বাঁধার বছরখানেক আগে থেকেই তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচন, জাতীয় ঐক্য এবং রাষ্ট্র সংস্কারের নিরলস দাবি জানিয়ে আসছেন। কোনো রাজনৈতিক নেতার থেকে এমন আহ্বান বাংলাদেশে অভূতপূর্ব। সসম্মানে তারেক রহমানকে দেশে ফেরানোতে আমি আশাবাদী।

লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; মহাসচিব, ইউট্যাব এবং বিএনপির নির্বাহী কমিটির গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য